ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়া যাবে কি যাবে না?
ইমামের পিছনে সূরাহ ফাতিহা পাঠ করা একটা ইজতেহাদী মাসআলা। এটা নিয়ে ইমামগণ মতবিরোধ করেছেন। তারা যা করেছেন তা কুরআন ও হাদীস অনুযায়ীই করেছেন। এ বিষয়ে তিনটি মত পাওয়া যায়:
১. ইমামের পিছনে সকল অবস্থায় (সিররী ও জাহরী সালাত) মুক্তাদী সূরাহ ফাতিহা পড়বে।
২. মুক্তাদী সিররী সালাতে ইমামের পিছনে সুরাহ ফাতিহা পড়বে, কিন্ত জাহরী সালাতে পড়বে না, ইমামের ক্বিরআত মনোযোগের সাথে শোনবে।
৩. মুক্তাদী সিররী হোক আর জাহরী সালাত হোক কোন অবস্থাতেই ইমামের পিছনে সূরাহ ফাতিহা পড়বে না।
সালাফী আলেমদের মতে দলীলের ভিত্তিতে প্রথম মতটি সবচেয়ে মজবুত এবং বাংলাদেশের আহলে হাদীসগণও এই মতের অনুসরণ করেন।ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা না পড়ার ব্যাপারে সূরাহ আ’রাফের ২০৪ নং আয়াতটি উল্লেখ করা হয়। মহান আল্লাহ বলেনঃ
আর যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তা মনোযোগ দিয়ে শোন এবং চুপ থাক, যাতে তোমরা রহমত লাভ কর।
আবার সহীহ হাদীসে আছে ‘উবাদাহ ইবনু সমিত (রাযি.) হতে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
যে ব্যক্তি সালাতে সূরাহ্ আল-ফাতিহা পড়ল না তার সালাত হলো না। [বুখারী হা:৭৫৬]
উপরের কুরআনের আয়াত টি আমভাবে ক্বিরআতের সময় চুপ থেকে মনোযোগের সাথে শুনতে বলা হয়েছে। আবার হাদীসে খাসভাবে শুরা ফাতিহা পড়তে বলা হয়েছে। এখন এর সমাধান কি হবে? কুরআন আল্লাহর ওহী আবার হাদীসও আল্লাহর তরফ থেকেই এসেছে। কুরআনে রাসূলুল্লাহ সা: এর আনুগত্যকে ফরয করে দিয়েছেন, যেমন – মহান আল্লাহ বলেনঃ
হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের কর্মকে নিষ্ফল করে দিও না। [সূরাহ মুহাম্মাদ:৩৩]
সুতরাং আমাদের কুরআন ও হাদীসের কথাকে বিপরীত বানিয়ে কোনটাকে প্রত্যাখ্যান করা যাবে না। সমন্বয় সাধণ করতে হবে যাতে কুরআন ও হাদীস উভয়ের আমল করা যায়।
‘আমর ইবনে শু’আয়িব তাঁর পিতা থেকে, তিনি তাঁর দাদা থেকে বর্ণনা করেনঃ নাবী (সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদল লোককে কুরআনের বিষয়ে বিতর্ক করতে শুনলেন। তখন তিনি (সা:) বললেন: তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তারা এ কারণেই ধ্বংস হয়েছে। তারা আল্লাহর কিতাবের এক অংকে অপর অংশ দ্বারা বাতিল করার চেষ্টা করেছিল। অথচ কিতাবুল্লাহ নাযিল হয়েছে এর এক অংশ অপর অংশের সমর্থক হিসাবে। সুতরাং তোমরা এর এক অংশকে অপর অংশ দ্বারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করবে না। বরং যা তোমরা জান কেবল তা-ই বলবে। আর যা জান না তা যে জানে তার কাছে সপর্দ করবে। [আহমাদ হা: ২৭০২, মিশকাত ২২৭ সনদ হাসান (আলবানী)]
উপরের হাদীস থেকে সুস্পষ্ট হল, শরিয়াতে বর্ণিত বিষয়গুলো কখনই স্ববিরোধী নয়। একটি অপরটির সমর্থক। যদি বিপরীত পরিদৃষ্ট হয় তাহলে যোগ্য ব্যক্তিদের মাধ্যমে তাঁর সমাধান নিতে হবে এবং নিজের মত প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্য অন্যের দলীলকে রদ করার মনোবৃত্তি পোষণ করে কুরআন-সুন্নাহ নিয়ে তর্ক করা হারাম।এখন সুরাহ আ’রাফের বিষয় নিয়ে কথা বলা যাক – সূরার এই আয়াতটি মক্কায় নাযিল হয় কারণ এটা সূরা আ’রাফের ২০৪ নং আয়াত, আর সুরা আ’রাফ মক্কী সূরাহ এ বিষয়ে সকলেই একমত। এমনকি এই আয়াত নাযীল হওয়ার পরও সাহাবীগণ সালাতের মধ্যে কথা বলেছেন।এবং সূরাহ বাকারার ২৩৮ নং আয়াত নাযীল হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা সালাতে কথা বলেছেন। আর সূরা বাকারার এই আয়াতটি রাসূল সা: এর মদীনায় হিযরত করার পর নাযিল হয়েছে। সূতরাং সূরা আরাফের ২০৪ আয়াতের মাধ্যমে ইমামের পিছনে ক্বিরআত নিষিদ্ধ হয়েছে এমন দাবী করা সঠিক হলো না। কারণ সাহাবীগণ এ আয়াত দিয়ে এমটি বুঝেন নি এবং রাসূল সা:-ও তাদেরকে মক্কায় থাকা অবস্থায় সালাতে কথা বলতে নিষেধ করেন নি। তাই যেখানে সালাতে কথা বলাই নিষিদ্ধ করা হয় নি সেখানে এ আয়াত দিয়ে কিভাবে ইমামের পিছনে সূরাহ ফাতিহা পড়া নিষিদ্ধ হয়?সাহাবীগণ যে মদীনাতেও সালাতে কথা বলতেন তার প্রমাণঃ
যায়দ ইবনু আরক্বাম (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সময়ে সালাতের মধ্যে কথা বলতাম। আমাদের যে কেউ তার সঙ্গীর সাথে নিজ দরকারী বিষয়ে কথা বলত। অবশেষে এ আয়াত নাযিল হল- ‘‘তোমরা তোমাদের সালাতসমূহের সংরক্ষণ কর ও নিয়ানুমবর্তিতা রক্ষা কর; বিশেষ মধ্যবর্তী (‘আসর) সালাতে, আর তোমরা (সালাতে) আল্লাহর উদ্দেশে একাগ্রচিত্ত হও’’- (সূরাহ্ আল-বাক্বারাহ্ ২/২৩৮)। অতঃপর আমরা সালাতে নীরব থাকতে আদেশপ্রাপ্ত হলাম। (বুখারী, হা: ১২০০; মুসলিম ৫/৭, হাঃ ৫৩৯, আহমাদ ১৯২৯৮) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ১১২২, ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ১১২৭)
ইমাম তাহাবী রহ. এই হাদীস উল্লেখ করার পর লিখেছেনঃ
“এই হাদীস থেকে এটা প্রমাণিত হলো যে সালাতের মধ্যে কথা বলা নিষিদ্ধ হয়েছে মদীনায়, রাসূল সা: এর মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করার পর।” (শারহ মাআ’নিল আসার, ১/৩০৪)
একই বক্তব্য দিয়েছেনঃক) আল্লামা আইনি হানাফী রহ. (উমদাতুল ক্বারী ৭/২৬৯)খ) মুল্লা আলী ক্বারী হানাফী রহ. (মিরকাত ৩/২৯)গ) ইবনে তুরকামানী হানাফী রহ. (আল জাওহারুল নাক্বী, ২/৩৬১)সুতরাং এটা সুস্পষ্ট যে যেখানে সালাতে কথা বলাই নিষিদ্ধ ছিল না সেখানে এই আয়াত (সূরাহ আ’রাফ ২০৪) দিয়ে কিভাবে উম্মুল কুরআন (সূরাহ ফাতিহা) পাঠ নিষিদ্ধ হতে পারে? অথচ রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, “যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা পাঠ করে নাই, তার সালাত নাই।”ইমাম ফখরুদ্দীন আল-রাযী এই আয়াত (আর যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তা মনোযোগ দিয়ে শোন এবং চুপ থাক, যাতে তোমরা রহমত লাভ কর) এর শানে নুযুল বর্ণনা করতে গিয়ে ৫ টি বিবরণ উল্লেখ করেছেন। তিনি ৫ নং বিবরণে বলেছেন যে এই আয়াত মুসলিমদের উদ্দেশ্য করে বলা হয় নি বরং ইসলামের শুরুর দিকে কাফিরদের উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে। এর পর তিনি বলেছেন এটাই অধিক ভাল এবং যুক্তিযুক্ত বর্ণনা।ফলে দেখা যাচ্ছে এই বিখ্যাত মফাসসির ৫ম কারণটিই অধিক যুক্তিপূর্ণ বলেছেন কারণ সাহাবাগণও এই আয়াত দিয়ে সেরকম বুঝেন নাই যেমনটা ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা না পাঠ করার ব্যক্তিগণ দাবী করে থাকেন। ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পাঠ কখনও বন্ধ ছিল না। এটা সাহাবীদের আমল থেকেই চলে আসছে। তাবেয়ীগণও তা অনুসরণ করেছেন। কুরআনের অন্যান্য আয়াত যা সূরা ফাতিহা পাঠের বৈধতা দেয়, মহান আল্লাহ আরো বলেনঃ
এবং আমি আপনাকে সাতটি বার বার পঠিত আয়াত, এবং মহান কুরআন দিয়েছি। [হিজর: ৮৭]
রাসূল সা: জানিয়ে দিয়েছেন সেই বার বার পঠিত সাতটি আয়াত হলো সূরাহ ফাতিহা (বুখারী)। কাতাদাহ বিন দি‘আমাহ (তাবেঈ) বলেন:
ফরয বা নফল যে সালাতই হোক না কেন, সূরাহ ফাতিহা প্রতি রাকআতেই পাঠ করা হয়।
মহান আল্লাহ আরো বলেন:
অতএব, কুরআনের যতটুকু তোমাদের জন্য সহজ মনে হয় ততটুকুই তিলাওয়াত কর। [সূরাহ আল-মুযাম্মিল: ২০]
এই আয়াতটিতেও আমভাবে সকলকে তিলাওয়াত করতে বলা হয়েছে। তিলিওয়াত ফরজ হওয়ার জন্য এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ আয়াত। সুতরাং এ আয়াতটি বাহ্যিকভাবে সূরা আ’রাফের আয়াতের সাথে বিরোধী মনে হয়। আবার হাদীস থেকে জানা গিয়েছে সূরাহ ফাতিহা ছাড়া সালাত হয় না। সুুতরাং উপরের আয়াত ও হাদীসসে সমন্বয় করলে বুঝা যায় মুক্তাদি শুধু সুরা ফাতিহা পড়বে। আর এ সূরাটিই পড়া বার বার পড়া হয় এবং পড়াও সবচেয়ে সহজ।মহান আল্লাহ বলেনঃ
“এবং যখন তাদেরকে (কুরআন) তিলাওয়াত করে শোনানো হয়, তখন তারা বলে: আমরা এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি। এটা আমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে পরম সত্য।” [সূরাহ ক্বাসাস: ৫৩]
তিনি আরো বলেনঃ
(এবং যখন তারা তাদের রাসূলের (সা) প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে, তা মনোযোগ দিয়ে শোনে) তখন তারা বলে: হে আমাদের প্রভু! আমরা বিশ্বাস স্থাপন করছি; অতএব আমাদেরকে সাক্ষ্যদাতাদের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করুন। [সূরা মায়িদাহ: ৮৩]
এ দু’টি আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, কুরআন তিলায়াতের সময় কথাও বলা যায়। সুতরাং ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়ার নিষেধাজ্ঞা কোথায়? বরং এটা রাসূল সা: এর হাদীসের অনুসরণ যার অনুসরণ করা আমাদের জন্য ফরয। সুতরাং চুপে চুপে ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়া কুরআনের হুকুমের বিরোধিতা নয়। আর হানাফীগণও এই আয়াত অনুসরণ করেন না। সালাতের মধ্যে তারা সানা পাঠ করেন। একসাথে কুরআন খতম করেন। হিফসখানায় সবাই একসাথে কুরআন পড়েন। যদি সূরা ফাতিহা পড়াই নিষিদ্ধ হতো তাহলে তাদের এই অনুশীলনও বন্ধ করা উচিত।
রাসূল (সা:) এর বানী থেকে সূরাহ ফাতিহা পড়ার আবশ্যিকতাঃ হাদিস অনুসারে মুক্তাদির সূরাহ ফাতিহা পড়া জরুরী। আর হাদীস অনুসরণ করা মানে কোরআনের বিরোধিতা নয়। বরং হাদীস হলো কুরআনের তাফসীর আর এটাই সাহাবাদের আমাল ছিল। যেমন সহীহ মুসলিমে জাবির রা: থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ
“রসূলুল্লাহ আমাদের মাঝে ছিলেন এবং তাঁর প্রতি কুরআন নাযিল হচ্ছিল। তিনি সেগুলোর তাফসীর জানতেন এবং যা তিনি (সা) আমল করতেন আমরাও তা-ই করতাম।”
সুতরাং রসূলুল্লাহ সা: এর হুকুম “সূরা ফাতিহা ছাড়া সালাত নেই” কুরআনের বিরোধী নয়। কুরআনের আয়াত “যখন কুরআন পড়া হয় তখন শোন এবং চুপ থাক” – আয়াতটিতেও সূরা ফাতিহা পাঠের ব্যাপারে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। আয়াতটি মুত্বলাক (ব্যাপকার্থক), আর হাদীসটিতে সুরা ফাতিহাকে খাস (সুনির্দিষ্ট অর্থবোধক) ভাবে বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং ঈমানের দাবী হল, সূরা ফাতিহার হুকুম এ ব্যাপারে স্বতন্ত্র। যদি আয়াতটিতে সূরা ফাতিহা পাঠের নিষেধাজ্ঞা থাকত, তবে রসূলুল্লাহ সা: কখনই তা পাঠের হুকুম দিতেন না। আর সাহাবাগণও সূরা ফাতিহা পাঠের ব্যাপারে আপত্তি জানাননি।ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়া জরুরী। নিচের হাদীসগুলো তার দলিলঃ
১. উবাদা ইবনে সামিত রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেছেন, “যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা পাঠ করে না তার সালাত হয় না।” [বুখারী, হা: ৭৫৬, মুসলিম ও অন্যান্য]
এ হাদীসটি ইমাম, মুক্তাদী, একাকী সলাত আদায়কারী নির্বিশেষে সকলেই এর অন্তর্ভূক্ত। বুখারী শরীফের বিখ্যাত ভাষ্যকার ইমাম শিহাবুদ্দীন কাস্তালানী রহ. বলেন, এটাই হচ্ছে জমহুর মুহাদ্দিসীনের মাযহাব (অভিমত)। (দেখুন, ইরশাদুশ্ শারী, ২/৪৩৫)। রাসূল সা: এর অন্যান্য হাদীস থেকেও বুঝা যায় এতে ইমাম, মুক্তাদী ও একাকী সালাত আদায়কারী সকলেই শামিল।
২. ইয়াহইয়া ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে সায়িদ….নাফি‘ ইবনে মাহমূদ ইবনূর রবী‘ থেকে বর্ণিত। নাফি‘ র. বলেন, (একদা) উবাদা (রা:) ফজরের সালাত পড়তে বিলম্ব করলেন। মুআযযিন আবূ নুআইম রহ. নামাযের ইকামত দিলেন। আর আবূ নুআইম-ই সর্বপ্রথম বায়তুল মুকাদ্দাসে আযান দিয়েছেন। অতঃপর আবু নুআইম লোকদের নিয়ে সালাত পড়লেন। উবাদা (রা:) এলেন এবং আমি তার সাথে ছিলাম। শেষে আমরা আবু নুআইম এর পিছনে কাতারে দাঁড়ালাম। আবূ নুআইম (র.) সশব্দে কিরাআত পড়লেন। (ইমামের পিছনে) উবাদা (রা:) সূরা আল-ফাতিহা পড়লেন। সালাত শেষে আমি উবাদা (রা:) কে বললাম, অবশ্যই আপনি এমন একটি কাজ করেছেন, আমি জানি না এটি কি সুন্নাত, নাকি আপনি ভুল করেছেন? তিনি বলেন, তা কি? তিনি বলেন, আমি আপনাকে সূরা আল-ফাতিহা পড়তে শুনেছি, যখন আবু নুআইম রহ. সশব্দে কিরাআত পাঠ করেছেন। তিনি বলেন, হাঁ। রাসূলুল্লাহ (সা:) আমাদের কোন এক ওয়াক্তে সালাত পড়ান, যাতে তিনি সশব্দে কিরাআত পাঠ করেন। তার জন্য কিরাআত পাঠ জটিল অনুভূত হলো। সালাত শেষে তিনি আমাদের দিকে ফিরে বলেন: আমি যখন সশব্দে কিরাআত পড়েছি তখন কি তোমরা কিরাআত পড়েছ? আমাদের কেউ বললেন, অবশ্যই আমরা পড়েছি। তিনি বলেন: এরূপ করো না। তাই আমি বলছিলাম, কি ব্যাপার! আমার সাথে কুরআন নিয়ে বিবাদ করা হচ্ছে! আমি যখন সশব্দে কিরাআত পাঠ করি তখন তোমরা কুরআনের কোন অংশ (কিরাআত) পড়বে না, তবে সূরা আল-ফাতিহা পড়বে।
(সুনানে আদ-দারাকুতনী, হা: ১১৯০, ই.ফা) ইমাম দারাকুতনী বলেন, এই হাদীসের সমস্ত রাবী নির্ভরযোগ্য। হাদীসটি ইমাম বুখারী তাঁর জুযউল ক্বিরাতেও নিয়ে এসেছেন। ইমাম বায়হাকী (আল-সুনান: ১৬৫/২) হাদীসটি সাদাকাহ বিন খালিদের সনদে বর্ণনা করেছেন। বায়হাকী তার কিতাবুল কিরাআতে (পৃ:৬৪, হা: ১২১) বলেছেন, “এই সনদটি সহীহ, এবং এর বর্ণনাকারীগণ সিকাহ (নির্ভরযোগ্য)। এই হাদীসটিই প্রমাণ করে বুখারীতে উল্লেখিত উবাদা বিন সামিত রা: থেকে বর্ণিত ৭৫৬ নং হাদীসটি ইমাম, মুক্তাদী ও একাকী সালাত আদায়কারী সবার জন্য প্রযোজ্য।
৩. ইয়াহইয়া বিন ইউসুফ আল যামি+উবায়দুল্লাহ বিন আমর আল-রাকি+আইয়ুব বিন আবূ তামীমাহ+আবূ কিলাবাহ আবদুল্লাহ বিন যায়েদ আল-জারমি+আনাস (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহর রাসূল একবার সাহাবাদের সালাতে ইমামতি করছিলেন। সালাত শেষ করার পর তিনি সবার দিকে মুখ করে বললেন, “ইমাম যখন তিলাওয়াত করে তখন তোমরাও কি সালাতে তিলাওয়াত কর? তারা নীরব রইলেন। তখন আল্লাহর রাসূল (সা:) এ প্রশ্নটি তিনবার করলেন। তারপর একজন বললো: আমরা তিলাওয়াত করি।তখন আল্লাহর রাসূল (সা:) বললেন: এটা তোমরা করবে না, এবং তোমাদের প্রত্যেকে চুপে চুপে সূরাহ ফাতিহা পাঠ করো।
[সহীহ ইবনে হিব্বান (মাওয়ারিদ: ৪৫৮, ৪৫৯] আবূ ইয়ালা (আল-মুসনাদ: হা: ২৮০৫), বুখারী (জুযউল কিরাআত)] এ হাদীসের সনদ সহীহ। আলবানী, আহমাদ শাকীর, শোয়াইব আরনাউত্ব, ইবনে হিব্বান হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
৪. ইমাম বুখারী+আদনান (আবদুল্লাহ বিন উসমান)+ইয়াযিদ বিন জুয়ারী+খালীদ (আল-খাদায়া)+আবূ কিলাবা (আব্দুল্লাহ বিন যায়েদ আল-যারমি)+ইবনু আবূ আয়িশাহ থেকে বর্ণিত, তিনি একজন সাহাবী থেকে বর্ণনা করেন, যিনি রাসূল (সা:) এর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন, তিনি বলেন: আল্লাহর রাসূল (সা:) এক সালাতের ইমামতি করছিলেন, সালাত শেষ করার পর তিনি বললেন: ‘ইমামের ক্বিরাআত করার সময় সম্ভবত তোমরা পড়ে থাক? সাহাবীগণ বললেন, হ্যাঁ, আমরা অবশ্যই পড়ে থাকি। রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন, এরূপ করবে না, তবে তোমরা প্রত্যেকেই সূরাহ ফাতিহা নীরবে পড়বে।
[বুখারী, জুযউল কিরআত, বায়হাক্বী (আল-সুনান, ১৬৬/২, কিতাবুল ক্বিরাআত পৃ: ৭৫,৭৬ হা: ১৫৬), আহমদ হা: ১৮২৩৮, মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাক, হা: ২৭৬৬]ইবনে হাজার আসকালানী বলেন, এর সনদ হাসান (আত-তালখীসুল হাবীর: ২৩১/১, হা: ৩৪৪) ইবনু খুযাইমাহ এ হাদীস থেকে দলীল গ্রহণ করেছেন, ইবনে হিব্বান একে মাহফুজ (সংরক্ষিত) বলে আখ্যা দিয়েছেন (আল-ইহসান: হা: ১৮৪৯)। শাইখ যবাইর আলী যাই রহ. বলেন এর সনদের প্রত্যেকটি রাবী সিকাহ। রাসূল সা: এর সকল সাহাবী নির্ভরযোগ্য, তাদের নাম যদি নাও জানা যায় তাতে কোন ক্ষতি নেই।
৫. ইমাম বুখারী+শুযায়ু ইবনে ওয়ালীদ+নাযার বিন মুহাম্মাদ আল ইয়ামানী+ইকরিমাহ বিন আম্মার+আমর বিন সা‘দ+আমর বিন শু‘আইব+শুআই বিন মুহাম্মাদ+আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আস (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি তার পিতা হতে দাদার সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: আল্লাহর রাসূল (সা:) বলেছেন: “তোমরা কি আমার পিছনে ক্বিরআত কর? জবাবে সাহাবীগণ বললেন: হ্যা! আমরা দ্রুত ক্বিরাআত করি। তিনি (সা:) বললেন: সূরাহ ফাতিহা ব্যতীত অন্য কোন কিছু পড়বে না।”
[বুখারী, জুযউল কিরাআত, বায়হাক্বী, কিতাবুল ক্বিরাআত, হা: ১৬৭] হাদিসের সনদ হাসান।
৬. উবাদাহ ইবনুস সামিত সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমরা রাসূলুল্লাহ সা: এর পিছনে ফজরের সালাত আদায় করছিলাম। সলাত রসূলুল্লাহ সা: এর কিরাআত পড়াকালে ক্বিরাআত তাঁর জন্য ভারী হয়ে গেল। সলাত শেষে তিনি (সা:) বললেন, সম্ভবত: তোমরা তোমাদের ইমামের পিছনে ক্বিরাআত করেছে। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রসূল!হ্যাঁ। তখন তিনি (সা:) বললেন, এমনটি কর না, তবে তোমাদের সূরাহ ফাতিহা পড়াটা স্বতন্ত্র। কেননা যে ব্যক্তি সূরাহ ফাতিহা পাঠ করে না, তার সলাত হয় না। [আবূ দাউদ, হা: ৮৬৩, তিরমিযি হা: ৩১১]
আলবানী হাদীসটিকে দূর্বল বলেছেন। ইমাম তিরমিযি বলেছেন এর সনদ হাসান। হাফিজ ইবনে হাজার দিরায়া গ্রন্তে বলেন এর সমস্ত বর্ণনাকারী মজবুত। ইমাম হাকিম এর সনদকে মুস্তাকিম বলেছেন। শোয়েব আরনাউত এ হাদীসকে সহীহ লিগাইরিহি বলেছেন। আহমাদ শাকীর শাওয়াহিদসহ একে সহীহ বলেছেন।উপরের হাদীসগুলো থেকে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো “যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা পাঠ করে না তার সালাত হয় না।” [বুখারী ৭৫৬] – এই হাদীসটি ইমাম, মুক্তাদী ও একাকী সালাত আদায়কারী সকলের জন্যই প্রযোজ্য। এ জন্যই সমস্ত মুহাদ্দিসগণের সর্দার ইমাম বুখারী রহ. এই হাদীস বর্ণনার পূর্বে অনুচ্ছেদ নির্ধারণ করেছেন: প্রত্যেক সালাতেই ইমাম ও মুক্তাদীর ক্বিরাআত (সূরাহ ফাতিহা) পড়া ওয়াজিব। মুক্বীম অবস্থায় হোক বা সফরে, সশব্দে ক্বিরাতের সালাত হোক বা নি:শব্দে। (দেখুন সহীহুল বুখারী, ১ম খন্ড, ১০/৯৫)
সাহাবীগণ সুরা ফাতিহা যেভাবে পড়তেনঃ সাহাবীগণ যেভাবে সূরা ফাতিহা পড়তেন তাতে কুরআনের কোন আয়াতের সাথে সাংঘর্ষিক হয় না। নিচের হাদীসগুলো দেখুনঃ
১. আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা:) বলেন: সাহাবাগণ রাসূলুল্লাহ সা: এর পিছনে ঐ সময় ক্বিরাআত করতেন যখন তিনি চুপ থাকতেন, পুণরায় যখন নবী সা: ক্বিরাআত পাঠ করতেন তখন সাহাবাগণ কিছুই ক্বিরাআত করতেন না। আবার যখন তিনি সা: চুপ থাকতেন তখন তাঁরা পাঠ করতেন। [বায়হাকীর কিতাবুল কিরাআত, পৃ: ৬৯; তিনি একে সহীহ বলেছেন]
২. আবূ হুরায়রা রা: বলেন: যখন ইমাম চুপ থাকেন তখন তোমরা ক্বিরাআত করা, আর যখন ইমাম ক্বিরাআত করে তখন তোমরা চুপ থাক। [বায়হাকীর কিতাবুল ক্বিরাআত, পৃ: ৬৬, সনদ হাসান] ইমাম যদি বিরতি না দেন তাহলে কিভাবে ক্বিরাআত করতে হবে তাও সাহাবী আবূ হুরায়রা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, “যখন ইমাম সূরা ফাতিহা পড়ে তখন তোমরাও পড় এবং তার পূর্বে শেষ করো। [বুখারী, জুযউল কিরাআত, সনদ হাসান] এ আসারটি ঐ কথার ব্যাপারে সুস্পষ্ট দলীল যে, আবূ হুরায়রা রা: জেহরী সালাতে মুক্তাদীকে সূরা ফাতিহা পড়ার হুকুম দিতেন। বিখ্যাত তাবেয়ী ফকীহ ইমাম মাকহুল ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়ার পদ্ধতি সম্পর্কে বলেছেন, “ইমাম জেহরী সালাতে যখন সূরা ফাতিহা পাঠ করে চুপ থাকেন তখন তোমরা চুপে পড়ে নাও। যদি চুপ না থাকেন তবে তার পূর্বে বা পড়ে পড়ে নাও। আর কোন অবস্থাতেই তা ছেড় না। [আবূ দাউদ ১/১৬০]